এ অশ্রুজলে বিলাস সাজে না, চিক্কোবি!
“১৯৬০ ওর গদাআনে ভাজেই নেজেয়ে সেই সুখকানি” / “১৯৬০ এর বাঁধটা ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই সুখগুলো”
আমার খুব প্রিয় একটি গানের এই লাইনটি শোনার পর থেকে আমার প্রচন্ড কৌতুহল গানটির মাধ্যমে কোন সে সুখের কথা স্মরণ করেছেন গীতিকার! চাকমা ভাষায় গদা মানে বাঁধ। বোঝাই যাচ্ছে এখানে কাপ্তাই বাঁধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। গানটিতে কাপ্তাই বাঁধ পরবর্তী একটি বিরহী অনুভূতির চিত্র পাওয়া যায়। চাকমা গানটির প্রথম কলিটি এরকম-
“তর আর মর দেগা ওয়ে ইধোত আগে মারিশ্যা লঞ্চানত”/
(মনে পড়ে তোমার- আমার দেখা হয়েছিলো মারিশ্যার লঞ্চটায়)
বাঘাইছড়ি বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি উপজেলা। অথচ কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার আগে এই বাঘাইছড়ি/মারিশ্যা অঞ্চলটি ছিল মূলত মায়ানি রিজার্ভ ফরেস্ট। এখন মারিশ্যায় লঞ্চ চলে। রাঙ্গামাটি থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলায় যাওয়ার একমাত্র ভরসা এইতো কিছুদিন আগেও এই নৌপথই ছিল। এখন অবশ্য খাগড়াছড়ি-দীগিনালা হয়ে সড়কপথেও যাওয়া যায়। রাঙামাটি থেকে নৌপথে বাঘাইছড়ি/মারিশ্যা যাওয়ার পথে লংগদু উপজেলার সদর বাজার ঘাটে পৌঁছানোর আগে হাট্টলী বিল নামে একটা বড় বিল পার হয়ে যেতে হয়। এই বিল এখন সারাবছর কাপ্তাই বাঁধের আটকানো পানির নীচে ডুবে থাকে। কিন্তু একটা সময় এই বিল ছিল উর্বর চাষযোগ্য ভূমি, সেখানে ছিল অনেক “ভরন্দি আদাম” /(সুজলা-সুফলা গ্রাম!)-র সমন্বয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। তাই গীতিকার আপসোসের সুরে বলেছেন,-
হাক্কন পরে হাট্টলী মাদত দেগা অহল দিজনর
বুজেই দিলুঙ এই পানিত তলে জাগায়ানি এল আমার!
(কিছুক্ষণ পরে হাট্টলী মাঠে দেখা হলো দুজনার
বুজালাম তোমায় এই পানির নীচের জমিগুলো ছিলো আমাদের!)
কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার পরে গ্রামের পর গ্রাম, পুরাতন চাকমা রাজবাড়ি, উর্বর শস্যভূমি চোখের সামনে তলিয়ে যায়। হাজার হাজার উদ্বাস্তু পাড়ি জমায় পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা আর অরুণাচল প্রদেশে। সম্পূর্ণ বদলে যায় একটি সমৃদ্ধ জনপদের জনমিতি, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। এই বাঁধ এর কারণে উদ্বাস্তু হওয়া শতশত পরিবার কে কোথায় পাড়ি জমাল তার চিত্রটা মেলে গানটির এই কলিতে-
হিয়োই গেলাক ওই থেগাকূলে, হিয়োই গেলাক মিজোরাম
তিবিরে, আসাম আর অরুণাচল হিয়োই থেলাক চাদিগাঙ!!
(কেউ গেলো ওই থেগাকূলে, কেউ গেলো মিজোরাম
ত্রিপুরা, আসাম আর অরুণাচল, কেউ থাকলো চাদিগাঙ!!)
(চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামটাকে হিল চাদিগাঙ বলেও অভিহিত করে থাকে)
কর্ণফুলী নদীটিকে চাকমারা বরগাঙ বলে সম্বোধন করে। এই বরগাঙকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ এক জনপদ। বড়গাঙ তাই মিশে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-কবিতা, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা এবং দ্রোহ-সংগ্রামের সামগ্রিকতায়। বরগাঙের পাড়ে পুরাতন রাঙামাটি শহরটি কেমন ছিলো তার একটি খন্ডচিত্র পাওয়া যায় খুব বিখ্যাত একটি চাকমা গানে-
হিল্লে আধিক্কে স্ববনত দেক্কোং পুরান রাঙামাত্যে
তুত্তে বোইয়ের বাহর্ , সিমেই তুলা উড়ি যার, স্ববনত দেক্কোং বরগাঙও পার
(গতকাল হঠাৎ স্বপ্নে দেখলাম পুরাতন রাঙামাটি
প্রবল এলোবাতাসে শিমূল তুলা উড়ে যায়, স্বপ্নে দেখলাম বরগাঙ এর পার।)
এরপরের কলিগুলো,-
ভাজি উত্তে বুইয়ানি, ভাজি উত্তে ঘরান মর
চিগোন হালর সমাজ্জেগুন বালুচরত খারা অদন
(ভেসে উঠেছে ধানখেতগুলো, ভেসে উঠেছে ঘরটি আমার
বালুর চরে খেলা করে ছোট্টবেলার সাথীরা আমার)
আবার,-
বার্গী পেখকুন উড়ি যাদন, টদেকখুনে ধান হাদন
ছাভা ছাভা মিধে রোদত হোগিলুনে গীদ গাদন।
(বার্গী পাখিরা উড়ে যায়, টিয়াপাখিরা ধান খায়
ছায়াময় মিষ্টি রোদে কোকিলেরা গান গায়।)
বরগাঙের পারে আদাম ছিলো, সেই আদামগুলোতে এলোবাতাসে বড় বড়- উঁচুউঁচু শিমূল গাছের নরম তুলাগুলো মেঘের পানে ভাসতো, বার্গী পাখিরা নীলআকাশে উড়ে বেড়াতো, কোকিলরা মিষ্টি রোদের ছায়ায় কুহু কুহু ডাকতো। বরগাঙের পারে বালকদের নিআলজি খেলা, ঘরের সিংগবা জুড়ে মায়েদের পানজা নাগর, উফ! পুরাতন রাঙামাটি।
এমনে এমনে তো আর প্রবাদ হয়নি, বরগাঙানও চাই পারা-খাদিয়ানও ধয় পারা (বরগাঙটাও দেখে আসি-খাদিটাও ধুয়ে আসি) । বরগাঙ এবং পুরান রাঙামাটির স্মৃতি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের গানে-কবিতায়। অন্য আরেকটি চাকমা গান এরকম-
ওই দেগোচনি চেঙে দুয়ার, যিয়োত আগে রিজার্ব বাজার
তা পূগেন্দি গাঙও সঙমধ্যে এলঅ ম’ আদাম
সেক্কে ন এল্ পানি, ন অয় গদাগান
গাঙও পারত আমি থেদং মিলি-ঝুলি!!
(দেখছো কি ওই চেঙে-র মুখ, যেখানে আছে রিজার্ব বাজার
তার পূবে গাঙ-র মাঝে ছিল আমার গ্রাম
তখন আসেনি পানি, ছিল না কোন বাঁধ
গাঙের পারে মোরা ছিলাম মিলেমিশে!!)
বর্তমান যে রিজার্ব বাজার লঞ্চঘাট, ঠিক সেখানটাই বা তার কিঞ্চিত একটু পাশেই ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান নদী চেঙের মুখ। চেঙে নদীটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরের দিক থেকে এসে খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি হয়ে এই রিজার্ব বাজারেই বরগাঙের সাথে মিলিত হয়েছে। গানটিতে চেঙে নদীর মুখের পূর্ব পাশে পুরাতন রাঙামাটি শহরকে কেন্দ্র করে যে গ্রামগুলো ছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে।
“গাজঅ ফাগন্দি জুনান যেক্কে উধে, ইধোত তুলিচ মরে” / (গাছের ফাঁক বেয়ে যখন জোছনা ছড়ায়, মনে করো আমায় ) ব্যাপক জনপ্রিয় এই চাকমা গানটিতে গীতিকার সুরে সুরে বরগাঙের উপর গদা/বাঁধ হওয়ার আগে যে চিত্র তার স্মৃতি তাঁর প্রেয়সীকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এভাবে-
এক কুড়ি বজর আগর কধানি, আহজি যিয়েগোই গদা পানিত!!
সলিল রায়ও হধা ইধোত উধে নি, দলাচানও গীদ কানত বাজে নি??
ত মনঅ সুন্দুক্কোত থোগেই চেলে, থোগেই পেবে!!
এচ্চে তুই হুধু আগচ হিজেনি, ন দেগং তরে গদাআন উয়ে ধুরি!!
(কুড়ি বছর আগের সেই কথাগুলো তলিয়ে গেছে বাঁধের পানিতে!!
সলিল রায় এর কথা কী মনে পড়ে, কানে কী বাজে দলাচানের গান??
তোমার মনের সিন্দুকে খুঁজে দেখ, পেয়ে যাবে!!
আজ তুমি কোথায় আছো জানি না, বাঁধটি হওয়ার পরে নেই কোন দেখা!!)
কত বিরহের উপাখ্যান এই বাঁধ জন্ম দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কত গেরস্তের ঘর ভেঙেছে, কত স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে এই অভিশপ্ত বাঁধ তা মনে না করে জুম্মবী থাকতেই পারে না। চিক্কোবি ইধোত তুল সে হধানি, ইধোত তুল।
অন্য আরেকটি গানে বাঁধটির কারণে অভিশপ্ত উদ্বাস্তু জীবনের কথা গীতিকার স্মরণ করেছেন এভাবে-
গদান অবার পরেন্দি, নানান মানেই নানান জাগাত
যিয়োন তারা মনত দুখকানিলোই, যিয়োন তারা মনত দুখকানিলোই!
(বাঁধটি হওয়ার পরে, নানান মানুষ নানান জায়গায়
চলে গেল তারা মন:কষ্টে, চলে গেল তারা মন:কষ্টে!)
আবার,-
“বেলান ডুপ্পেগোই জুনান উট্টে আগাজত, গোদা দিন্নো দুগ গরিনেই, বোচ্চোঙ ইঝোরত”/ (সুর্য ডুবে গেছে, জোছনাটা ওই আকাশে, সারাটা দিন কষ্ট করে, বসে আছি ইঝোরে)- জনপ্রিয় এই চাকমা গানটিতেও গদা/বাঁধ হওয়ার আগে পুরাতন চাকমা রাজবাড