দিগন্ত বিস্তৃত সরোবর। সে সরোবরের শান বাঁধানো ঘাট সবসময় সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত। যখনই যে বিষয়ে স্যারের কাছে গিয়েছি স্যার কখনো না করেননি। দেখাননি ব্যস্ততার এতটুকু অজুহাত। বিশেষ করে বিভিন্ন বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে Apply করতে Recommendation letter এর জন্য কারণে অকারণে কতবার বিরক্ত করেছি কিন্তু স্যারের আচরণে বিরক্তির এতটুকু লেশও দেখিনি।আসলে হাকিম স্যারের কাছাকাছি থাকাটাই এক ধরণের সাহস। কারণ কোন কাজ করতে গেলে যদি বড় কোন ভুলও হয়ে যায় তবে স্যার মৃদু মন্দ বাতাসের মতো মিষ্টি করে একটু বকা দিবেন বড়জোর।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ মানুষ বিনাশ করতে পারে, কেড়ে নিতে পারে, অর্জন করতে পারে, আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু এজন্যই যে মানুষ বড় তা নয়। মানুষের মহত্ত্ব হচ্ছে মানুষ সকলকেই আপন করতে পারে।মানুষের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তাঁরা পরিপূর্ণ বোধশক্তির দ্বারা একথা বলতে পেরেছেন যে, ছোট হোক বড় হোক, উচ্চ হোক নীচ হোক, শত্রু হোক মিত্র হোক – সকলেই আমার আপন। “
সকলকে অতি সহজেই আপন করে নেওয়ার মতো এক দুর্লভ গুণের অধিকারী আমাদের স্যার। স্যারের সাহচর্য তাই সব সময় মধুর ও আনন্দদায়ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে পরিচয় হওয়ার পর যখন শুনতো আমি মাইক্রোবায়োলজিতে পড়ি, তখন সাগ্রহে বলে উঠত- ও আপনি হাকিম স্যারের ছাত্র। এরপর বিভিন্ন সময়ে স্যারের কাছ থেকে পাওয়া উপকারের কথা বর্ণনা করত। স্যার এক সময় বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ২ নং গেইট এলাকায় থাকতেন। তখন আমি পাশেই একটি কটেজে থাকতাম। তখন দেখতাম স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সাথে অকৃত্রিমভাবে মিশতেন।
স্যারের চরিত্রের মানবিকবোধের দিকটা খুবই প্রবল এবং যে কাউকেই তা আকৃষ্ট করবে। আনবিক পৃথিবীর নানা জটিলতাকে পায়েদলে দূরে ঠেলে স্যার নিজের মাঝে সব সময় লালন করে গেছেন এক অপার্থিব মানবিক হৃদয়। নানা বৈষয়িক জটিলতার ঘোর দ্বন্দ্ব সংঘাতেও স্যারকে কখনও তাঁর চেতনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে তিল পরিমাণ বিচ্যুত হতে শুনিনি। কখনো শুনিনি ক্ষমতার প্রিয় প্রলোভনের দ্রবণে স্যার নিজের নীতি দ্রবীভূত করেছেন।
ছাত্রছাত্রীদের কল্যাণ কামনার বিভায় সব সময় উদ্ভাসিত থাকে স্যারের অন্তর। স্বতাড়িত কর্তব্যবোধে জারিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসে দায়িত্ব পালনে ব্রতী হন স্যার। মনে পড়ে, তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষার আগে আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল পরীক্ষাই হয়তো দিতে পারব না। স্যার সব সময় বন্ধুবান্ধব আর জুনিয়রদের কাছে আমার খোঁজ খবর নিতেন এবং কোন প্রয়োজন হলে জানাতে বলেছিলেন।
স্যার একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রক্টরের দায়িত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতাপশালী দায়িত্ব পাওয়ার পরও স্যারের আচরণের চিরন্তন সরলতার দিকটিতে একটুও কমতি দেখিনি। অনেক জটিল বিষয়ও স্যার স্বভাবসুলভ সরলতায় সরলীকরণ করে সমাধান দিতেন।
মেদহীন, ঋজু শরীর স্যারের । শরীরে যেমন মনেও তেমন ভদ্র, পরিমিত, শীলিত। নিজের কর্তব্যবোধের ঝাণ্ডাকে সব সময় উর্ধে তুলে ধরে সুদীর্ঘ ৪০ বছর যাবত নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে স্যার আজ বিদায়লগ্নের কাছাকাছি। অসাধারণ পরিমিতিবোধের এই মানুষটিকে সব সময় দলমত নির্বিশেষে সবার অযুত অভিনন্দনে সিক্ত হতে দেখেছি। ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনে এ এক বিরাট অর্জন।